রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:২১ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, বিশেষ প্রতিনিধি লামাঃ
উন্নয়নের সংজ্ঞা নির্ধারণ খুবই কঠিন। আজ পর্যন্ত উন্নয়নের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। একেক তাত্তি¡ক এক ধরনের সংজ্ঞা দিয়েছেন। অর্থনীতিবিদরা সব সময়ই উন্নয়নের সংজ্ঞার মধ্যে অর্থনীতিকে টেনে এনেছেন। সমাজ বিজ্ঞানীরা উন্নয়নের সংজ্ঞার মধ্যে সমাজের উন্নয়নকে জোর দিয়েছেন। মনোবিজ্ঞানীরা উন্নয়নের সংজ্ঞার মধ্যে মানুষের মন-মানসিকতার উন্নয়নকে জোর দিয়েছেন। প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীরা উন্নয়নের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারের ওপর জোর দিয়েছেন। নৃ-বিজ্ঞানীরা উন্নয়নের সংজ্ঞার মধ্যে সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে দেখা যায়, কেউই উন্নয়নের সর্বজনীন ও গ্রহণীয় সংজ্ঞা দিতে পারেননি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে ২১ বছর পরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে আওয়ামীলীগ। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পাঁচ বছরে সৃষ্টি হয়েছিল সাফল্যের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে ছিল, খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন। দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল থাকে। মূল্যস্ফীতির হার ১.৫৯ শতাংশে নেমে আসে। পক্ষান্তরে প্রবৃদ্ধির হার ৬.২ শতাংশে উন্নীত হয়। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, ২১ ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা অর্জন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভ, ডি-৮ ও বিমসটেক প্রভৃতি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম গঠন এবং এসোসিয়েশন ফর এশিয়ান পার্লামেন্টারিয়ান ফর পিস (এএপিপি) গঠন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে নতুন মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত করে।
দারিদ্র হ্রাসের বার্ষিক গড় হার ০.৫০ শতাংশ থেকে ১.৫০ শতাংশে উন্নীত হয় এবং মানব দারিদ্র্য সূচক ৪১.৬ থেকে ৩২ শতাংশে নেমে আসে। মানব উন্নয়ন সূচকে জাতিসংঘের ৫৬ পয়েন্ট অর্জন, স্বাক্ষরতা হার ৬৫ শতাংশে উন্নীতকরণ, শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেশনজট দূরীকরণ ছিল জাতির অগ্রগতির পরিচায়ক। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অর্জিত হয় বিস্ময়কর সাফল্য। মাত্র পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ, গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি ও আহরণের ব্যবস্থা, যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন, ৬২ হাজার কিলোমিটার কাঁচা-পাকা রাস্তা এবং ১৯ হাজার সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ প্রভৃতির মাধ্যমে একটি নির্ভরযোগ্য ভৌত অবকাঠামোর ভিত্তি রচিত হয়। অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় পাঁচ বছরে জাতীয় আয়ের ১৪.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশে এবং বিনিয়োগের হার ২০ শতাংশ থেকে ২৩.১ শতাংশে উন্নীত হয়।
আওয়ামী লীগের সেই সময়ের পাঁচ বছরে দেশে ছোট-বড় প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়। সরকারি উদ্যোগে প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য ১টি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের পাশাপাশি চিকিৎসার যন্ত্রপাতির ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করে বেসরকারি খাতে হাসপাতাল ও ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। মনোপলি ভেঙে দিয়ে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার মোবাইল মাত্র ২ হাজার টাকায় মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা, শুল্কহার কমিয়ে কম্পিউটার ও তথ্য-প্রযুক্তিকে সকলের জন্য অবারিত করে দেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশ ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করে। এই ৫ বছরের উন্নয়ন চিত্র বিগত যে কোন সরকারের উন্নয়ন সমীক্ষাকে হার মানাবে নিশ্চিত।
আজ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে পড়েছে উন্নয়নের ছোঁয়া। মানুষ কি উন্নয়ন বিবেচনায় ভোট দিবেনা ? উন্নয়ন বিবেচনায় কেন ভোট কম পাওয়ার আশংকা তা নিয়ে সাধারণ মানুষের হতে পাওয়া কিছু মতামত তুলে ধরা হল। হয়ত এই সামান্য অভিজ্ঞতা আগামীর পথচলা আরো সুন্দর করবে।
দৃষ্টান্ত- ০১। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বান্দরবানের লামা উপজেলায় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ে ৭১৪টি সোলার বিতরণ করা হয়। বড়-ছোট মিলে প্রতিটি সোলারের মূল্য গড়ে ৫০ হাজার টাকা। লামা উপজেলার একটি ইউনিয়নে সোলার বিতরণের চিত্র তুলে ধরলাম। সোলার পাওয়া একজন উপজাতি মহিলাকে প্রশ্ন করা হল এবার তো নিশ্চয় নৌকায় ভোট দিবেন ? তিনি বললেন কেন ? আমি বললাম এই যে এতদামী একটি সরকারি উপহার আপনি পেলেন। তিনি রাগ করে বললেন উপহার মানে, আমি তো ২ হাজার টাকার বিনিময়ে এইটা পেয়েছি। আমি বললাম এইটার দাম তো ৫০ হাজার টাকা। তিনি বললেন যত টাকাই হোক আমি তো ২ হাজার টাকার বিনিময়ে ক্রয় করেছি। তার মানে লামা উপজেলায় সরকারের ৭১৪টি সোলার ৩ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বিতরণ করেও নৌকার জন্য একটি ভোট সংগ্রহ করতে পারেনি। এই দায়ভার কে নেবে ?
দৃষ্টান্ত- ০২। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তর স¤প্রতি বান্দরবানের লামায় বেশ কিছু ডিপ টিউবয়েল দিচ্ছে। প্রতিটি ডিপ টিউবয়েল অফিস থেকে নিতে সরকারি খরচের কথা বলে সুবিধাভোগীর কাছ থেকে ৭-১০ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। সদ্য সময়ে লামা সাবেক বিলছড়ি এলাকায় ১০/১২ টি ডিপ টিউবয়েল দেয়া হয়। যে গুলো নিতে কিছু রাজনীতি নেতাদের সুপারিশ লেগেছে এবং অফিস খরচ পড়েছে ১৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা। প্রশ্ন হচ্ছে দলীয় নেতাদের সুপারিশ হলে অফিস খরচ বাড়ে না কমে ? এখানে অফিস খরচ বেড়েছে। এই নয়ছয়ের বিষয় গুলো নিয়ে সরকারের এতবড় উন্নয়ন কর্মসূচী আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এই দায়ভার কে নেবে ? লাখ থেকে দেড় লাখ টাকার ডিপ টিউবয়েল পেয়েও সুবিধাভোগী সন্তুষ্ট নয়। কারণ তাকে এই সুবিধা পেতে মোটা অংকের টাকা গুণতে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সুবিধা পেয়েও তারা নৌকায় ভোট দিবে কিনা তা নিয়ে রয়ে গেছে শংকা।
দৃষ্টান্ত- ০৩। বিদ্যুতের অভাবনীয় উন্নয়ন স্বীকার করছি। সম্প্রতি সময়ে বান্দরবানের লামায় বিদ্যুতের লাইন সম্প্রসারিত হচ্ছে। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায় প্রতিটি বিদ্যুতের খুঁটির জন্য গড়ে ৩ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। এই বিদ্যুতের লাইন সংযোগে কি স্থানীয় এমপি প্রার্থীর প্রতি সাধারণ মানুষের ভালবাসা বাড়বে ?
একইভাবে জনগণকে সরকারি সকল সুবিধা নিতে কোথাও না কোথাও বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। আর এই সামান্য কিছু অবৈধ লেনদেনের কারণে সরকারের হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রশ্নবিদ্ধ। আওয়ামীলীগ সরকার এত উন্নয়ন করেও যে সাধারণ মানুষের মন পাচ্ছেনা এইসব তার কারণ বলে জনতা মনে করে। উন্নয়ন দরকার কিন্তু তার চেয়ে সু-শাসন আরো বেশী জরুরী বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা।
Leave a Reply