শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:০৯ পূর্বাহ্ন
মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম,বিশেষ প্রতিনিধি লামাঃ
লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নের ফাদুরছড়া এলাকায় ভূমি জবরদখলে বাধা দেয়ায় কলেজ পড়ুয়া মেয়ে সহ পিতা-মাতাকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের ঘটনার ৪দিন পেরিয়ে গেলেও অন্যান্য আসামীরা এখনো আটক হয়নি। এতে করে নির্যাতনের শিকার আব্দুল করিমের পরিবার উৎকন্ঠা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে।
নির্যাতনের ঘটনায় গুরুতর আহত আব্দুল করিমের স্ত্রী ছফুরা খাতুন এখনো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। আব্দুল করিম ৪দিন চিকিৎসা গ্রহণ শেষে ৫ অক্টোবর শুক্রবার দুপুরে চকরিয়া হাসপাতাল হতে ছাড়া পায়। এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি বলে জানান প্রতিবেদককে। ফারুক বাহিনীর মারধর ও নির্যাতনে আহত কলেজছাত্রী জোহরা বেগম (১৭) ও তার মামা নূর মোহাম্মদ (৪০) চকরিয়া হাসপাতাল হতে প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করেছে।
শুক্রবার সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের আলাপকালে জানা যায়, গত ২ অক্টোবর ২০১৮ইং মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় ফাদুর ছড়া পাড়ার নুরুল ইসলামের ছেলে মো. ফারুক (৪৮) তার পরিবারের লোকজন সহ শতাধিক ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের নিয়ে আব্দুল করিমের বাড়ির উত্তর পাশের্^র ভোগদখলী জায়গায় ঘর নির্মাণ করে জবরদখলে চেষ্টা করে। এসময় আব্দুল করিম, তার স্ত্রী ছফুরা বেগম, মেয়ে জোহরা বেগম ও শ্যালক নূর মোহাম্মদ বাধা দিতে গেলে ফারুক বাহিনীর লোকজন গরুর গলা হতে রশি খুলে তাদের হাত বেঁধে ফেলে। কলেজ ছাত্রীকে জোহরা বেগমকে ছোট একটি গাছের সাথে বেঁধে শ্লীলতাহানী সহ মারধর ও তার বাবা, মা, মামাকে মাটিতে ফেলে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করতে থাকে। তারা ২ ঘন্টা ব্যাপী এই তান্ডব চালায়। এসময় হামলাকারীরা স্থানীয় কোন জনসাধারণ ও প্রতিবেশীদের আশপাশে আসার সুযোগ দেয়নি। কেউ আসতে চাইলে তাকে দা-ছুরি-লাঠি দিয়ে তাড়া করেছে ফারুক বাহিনী। পরে গ্রাম সর্দ্দার ও স্থানীয়দের থেকে খবর পেয়ে পুলিশ এসে ফারুক বাহিনীর নির্যাতন হতে আব্দুল করিমের পরিবারকে উদ্ধার করে ও হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠায়।
ফাদুরছড়া গ্রামের সর্দ্দার সিরাজুল ইসলাম (৬৫) বলেন, আব্দুল করিমের পরিবার উক্ত জায়গায় বসতবাড়ি ও জমি আবাদ করে ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে ভোগদখলে আছে। ঘটনার সময় করিমের পরিবারকে উদ্ধার করতে আমি এগিয়ে গেলে ফারুক তার লোকজন কাছে যেতে দেয়নি। নির্যাতন ও মারধরের ঘটনা শতভাগ সত্যি। কলেজ পড়–য়া মেয়েকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের ঘটনা দুঃখজনক। আমার মেয়ে মমতাজ বেগম (১৬) নির্যাতনের ঘটনা মোবাইলে ছবি-ভিডিও ধারন করতে কাছে গেলে তাকে দা দিয়ে তাড়া দেয় ফারুকের লোকজন।
ফাদুর ছড়া পাড়ার মুরুব্বী মো. হোচন (৫২) বলেন, সন্ত্রাসীরা স্থানীয় কাউকে কাছে যেতে দেয়নি। আমি পুলিশকে ফোন করেছিলাম। পুলিশ আসার পর গ্রামবাসী সহ আমরা গিয়ে করিমের পরিবারকে উদ্ধার করি। পুলিশ আসলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। ইন্টারনেটে আসা নির্যাতনের ছবি-ভিডিও পুলিশ আসার পর করা হয়েছিল। তাই সন্ত্রাসীদের তান্ডবের ছবি-ভিডিও করা সম্ভব হয়নি।
পাশর্^বর্তী আনছার উল্লাহর ছেলে আতাউল্লাহ (১২) ও আক্কাস এর ছেলে আব্দুর রহমান (১৪) বলেন, আব্দুল করিম দাদাকে মারধরে পর বেঁধে রোদে ফেলে রাখলে তিনি পানি পানি চিৎকার করতে থাকেন। আমরা পানি নিয়ে গেলে ফারুক ও তার লোকজন আমাদের দা লাঠি দিয়ে দৌঁড়ান দেয়। আমরা পালিয়ে আসি। আমদেরকে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়।
পাশ্বর্বতী আক্কাসের স্ত্রী আমেনা বেগম বলেন, ফারুক পাহাড়ি একটি জায়গার কাগজ নিয়ে অনেক জনের সাথে ভূমি বিরোধ করছে। সে আমাদের জায়গাও দখল করতে চায়। অনেক মানুষের সাথে সে জায়গা নিয়ে ঝামেলা করে।
পাশ্বর্বতী জসিম উদ্দিনের স্ত্রী খুরশিদা বেগম বলেন (৩৫) বলেন, ঘটনাসময় আমি করিমের ঘরে ছিলাম। বাড়ির সামনে নিচের জমিতে এই ঘটনা ঘটেছে। ৮ জন লোক করিমের ঘরে প্রবেশ করে তল্লাশী করে জায়গার কাগজপত্র নিয়ে যায় ও লুটপাট করে।
করিমের বাড়ির পূর্বপাশের বাসিন্দা আব্দুস সালামের স্ত্রী তাছলিমা বেগম (২৪) বলেন, স্থানীয় অলিউল্লাহ হতে আমি খবর পায় করিম খালুকে মারধর করে বেধে রেখেছে ফারুকের লোকজন। আমি এগিয়ে আসি, কিন্তু ঘটনাস্থলে যেতে চাইলে তারা দা দিয়ে তাড়া দেয়।
নির্যাতনের শিকার নূর মোহাম্মদ বলেন, আমাকে মারধর করে পিচমোড়া করে গাছের সাথে বেধে রেখেছিল। ২ ঘন্টা ধরে তারা আমাদের নির্যাতন করে। ঘটনাস্থলে তারা একটি ঘর তেরি করে। পরে পুলিশ এসে সেটা ভেঙ্গে দেয়।
নির্যাতনের শিকার কলেজ ছাত্রী জোহরা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, বাবা ও মা দুইজনে হাসপাতালে ভর্তি। চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে সময় পার করছি। ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারছিনা।
স্থানীয় ইউপি মেম্বার থোয়াই হ্লা মার্মা বলেন, ঘটনা শুনে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হই। করিমের পরিবারের উপর হামলা ও তার মেয়ে জোহরাকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের ঘটনা সত্য। এলাকার শত শত মানুষ তার স্বাক্ষী। এই অন্যায়ের বিচার না হলে তারা আরো বড় অন্যায় করতে সাহস পাবে। ফারুক ও তার বাহিনী কর্তৃক হামলার জন্য আনা শতাধিক লাঠি পুলিশ উদ্ধার করে আমার জিম্মায় দিয়ে গেছে। সেগুলো আমার হেফাজতে আছে।
এই বিষয়ে আরো জানতে অভিযুক্ত মো. ফারুকের বাড়িতে গেলে তার বাড়িতে কাউকে না পাওয়ায় ও মোবাইল বন্ধ থাকায় তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে একটি পক্ষ ঘটনাটি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। স্থানীয়রা অন্যান্য দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনকে অনুরোধ করেছে। হামলাকারী আব্দুর রশিদ বাদশা সহজে জামিনের বেড়িয়ে আসার বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে বিদ্রুপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। ন্যায় বিচার পাবে কিনা তা নিয়েও তারা সন্দিহান।
ফাইতং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. হানিফ বলেন, ঘটনার সময় আমি ফাইতং না থাকায় এএসআই সুজনকে পাঠিয়েছিলাম। অন্যান্য আসামীরা পলাতক থাকায় গ্রেফতার করা যাচ্ছেনা।
মামলার তদন্তকারী অফিসার লামা থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক জয়নাল আবেদীন বলেন, অন্যান্য আসামীদের আটকে কাজ করছে পুলিশ। বর্তমানে পরিবেশ শান্ত রয়েছে। ফারুক কর্তৃক নির্মাণ করা ঘরটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে ও হামলার জন্য আনা লাঠিসোটা জব্দ করে রাখা হয়েছে।
লামা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) অপ্পেলা রাজু নাহা জানিয়েছেন, নির্যাতনের শিকার আব্দুল করিমের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত সহ দোষীদের গ্রেফতারে পুলিশ কাজ করছে।
Leave a Reply