রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:০৩ অপরাহ্ন
ইমতিয়াজ কামাল ইমন, রাঙামাটি প্রতিনিধিঃ
পার্বত্যাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত স্বল্প জনসংখ্যার জাতিসত্ত্বাসমূহের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারী চাকুরিতে কৌটা বাতিলের অবস্থান থেকে সরে আসার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে পত্র দিয়েছেন রাঙ্গামটি চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়। আজ মঙ্গলবার দুপুরে সংবাদকর্মীদের কাছে ইমেইলে পাঠানো এক বার্তায় এই পত্রের অনুলিপি পাঠানো হয়।
চাকমা সার্কেল চীফ এর একান্ত সচিব সুব্রত চাকমা কর্তৃক পাঠানো পত্রে, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং স্থায়িত্বশীল লক্ষ্যমাত্রার যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং স্বল্প জনসংখ্যার জাতিসত্ত্বাসমূহের কাংখিত আর্থসামাজিক উন্নতি সাধিত হয়েছে মর্মে যথাযথ সমীক্ষা-লব্ধ তথ্য, নির্দেশক ও সূচক প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি সহ দেশের স্বল্প সংখ্যার জাতিসত্ত্বার নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সহ সকল সরকারী চাকরীর সংরক্ষিত আসন অব্যাহত রাখা ও পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আবেদন জানিয়েছেন চাকমা রাজা।
পাঠানো পত্রে উল্লেখ করেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আপনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িসহ দেশের অন্যান্য সুবিধা-বঞ্চিত বা “অনগ্রসর” স্বল্প সংখ্যার জাতিসত্তাসমূহের আর্থ-সামাজিক মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সাংবিধানিক ও অন্যান্য নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কার্যক্রমসমূহ আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি।
এর মধ্যে রয়েছে: (ক) ১৯৭২ সনে ওখঙ ঈড়হাবহঃরড়হ ঘড়. ১০৭ ড়হ ওহফরমবহড়ঁং ধহফ ঞৎরনধষ চড়ঢ়ঁষধঃরড়হং এর অনুসমর্থন; (খ) দেশের “অনগ্রসর অংশ” এর মৌলিক অধিকারসমূহ বৈষম্যহীনভাবে চর্চার সাপেক্ষে সাংবিধানিক বিধান প্রণয়ন [অনুচ্ছেদ ১৯, ২৮(৪), ২৯(৩), ইত্যাদি; (গ) সরকারী চাকরিতে পাহাড়িসহ দেশের স্বল্প সংখ্যার জাতিসত্ত্বাদের জন্য কোটা বরাদ্দ; (ঘ) সরকারী বিভিন্ন পদে জাতিগত ও ধর্মগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি; (ঙ) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সাক্ষর; এবং (ছ) পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিসত্তাদের জন্য পার্বত্যাঞ্চলের বিশেষ প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব ও নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ।
অন্যান্যের মধ্যে, এসব পদক্ষের ফলে পূর্বেকার সময়ের তুলনায় প্রজাতন্ত্রের সেবায় স্বল্প জনসংখ্যার জাতিসত্তার সদস্যদের প্রতিনিধিত্ব ক্রমশ: বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারী চাকরীর কোটার পূরণের ক্ষেত্রে অনেক অপূরণ চলমান রয়েছে।
অধিকন্তু, এবিষয়ে সন্মানিত মন্ত্রীপরিষদ সচিবের নেতৃত্বাধীনে সাম্প্রতিককালে পেশকৃত প্রতিবেদনে স্বল্পসংখ্যার জাতিসত্ত্বার সদস্যদের জন্য কোটা পদ্ধতির বিলুপ্তির জন্য যে সুপারিশ করা হয়েছে এবং এর যৌক্তিকতার স্বপক্ষে যে মতামত প্রদান করা হয়েছে এই মর্মে যে, “ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর” মানুষেরা বর্তমানে আর “অনগ্রসর” নেই, তা সংশ্লিষ্ট জাতিসত্ত্বাদের প্রতিনিধিদের সাথে যথাযথ আলোচনা ও পরামর্শের ভিত্তিতে এবং উক্ত জাতিসত্ত্বাসমূহের বর্তমান আর্থ-সামাজিক মর্যাদার যথাযথ পর্যালোচনার ভিত্তিতে করা হয়নি। শিক্ষা (প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও স্নাতক), স্বাস্থ্যসেবা (গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে), কর্মসংস্থান, খাদ্য ও পুষ্টি-নিরাপত্তা, সুপেয় জলের সরবরাহ, দারিদ্র বিমোচন, বিদ্যুৎ-সংযোগ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভূমি মালিকানার অধিগম্যতা, ইত্যাদি বিষয়ে চাকমা সার্কেলের পাহাড়ি সহ দেশের স্বল্প জনসংখ্যার জাতিসত্তার সদস্যদের অবস্থান দেশের অন্যান্য শ্রেণীর নাগরিকদের চেয়ে যে অনেক নিম্নস্তরের, এতে কোন সন্দেহ নেই। যেমনটি আপনার নির্দেশে গৃহীত বাংলাদেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে বর্ণিত রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভারত-প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের সিংহভাগ এখনও তাঁদের নিজস্ব ভিটামাটিতে অ-পুনর্বাসিত রয়েছে। উক্ত অঞ্চলের ভূমি বিরোধসমূহের নিষ্পত্তি এখনও সমাপ্ত হয়নি।
অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত উপজেলাগুলোতে (যথা, বাঘাইছড়ি, বিলেইছরি, দীঘিনালা, লক্ষ্মীছরি, থাঞ্চি, রুমা, ইত্যাদি) এবং রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকাতে (যথা, কাসলং, রেংখ্যং, সাংগু ও মাতামুহুরি রিজার্ভে), ভূমির অধিকারের অস্বীকৃতি, প্রত্যন্ততা এবং উন্নয়ন অবহেলার কারণে হা-ভাত, পুষ্টিহীনতা, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু, নিরক্ষরতা, বেকারত্ব ইত্যাদি সময়ান্তরে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে চলেছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, স্বল্পসংখ্যার জাতিসত্তার সদস্যদের বর্তমান মর্যাদা “অনগ্রসর” নয় মর্মে সন্মানিত মন্ত্রীপরিষদ সচিবের উপসংহার অনুমান-প্রসূত এবং সরকারী ও অন্যান্য গ্রহণযোগ্য আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা ও আদম-শুমারির তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ত্রুটিপূর্ণ ও ভিত্তিহীন এবং ফলশ্রুতিতে, বৈষম্যমূলক। সমতল অঞ্চলের রাজশাহী বিভাগ, বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল, সিলেট বিভাগ, সুন্দরবন অঞ্চল, বৃহত্তর পটুয়াখালী-বরগুনা অঞ্চল, বৃহত্তর কক্সবাজার-চট্টগ্রাম অঞ্চল প্রভৃতি এলাকার রিজার্ভ ফরেস্ট, চা-বাগান, জাতীয় উদ্যান, ইকো পার্ক, অভয়ারণ্য ও অন্যান্য এলাকার স্বল্প জনসংখ্যার জাতিসত্তার সদস্যদের ভূমিহরণের সমস্যাও অনুরুপভাবে এখনও চলমান রয়েছে, যাতে, অন্যান্যের মধ্যে, তাঁদের দরিদ্রতা বৃদ্ধমান রয়েছে এবং তাঁদের অন্যান্য আর্থ-সামাজিক, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে অ-বাস্তবায়িত রয়েছে।
এমতাবস্থায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িসহ দেশের অন্যত্রের স্বল্পসংখ্যার জাতিসত্তাদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে প্রণীত বৈষম্যহীন জননীতি অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে তাঁর সুযোগ্য তনয়া হিসেবে আমরা আপনার কাছে ন্যায্য, বৈষম্যহীন, বলিষ্ঠ ও অন্যান্যভাবে যথাযথ পদক্ষেপ আশা করি। চাকমা সার্কেলের অধিবাসীগণ কৃতজ্ঞতা ভরে সরণ করে যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আমলে এবং তাঁর প্রত্যক্ষ নির্দেশে আমার নাবালক অবস্থায় আমি যুবরাজ থাকাকালীন সদাশয় সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমাকে চাকমা চীফ-এর পদ ও মর্যাদায় নিয়োগদান ও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে। যেহেতু সাম্প্রতিক কালের কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মুল দাবি ছিল কোটা পদ্ধতির সংস্কার, এবং কোটা পদ্ধতির বিলুপ্তি নয়, এবং যেহেতু প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে কোটা বরাদ্ধ বহাল রাখার পক্ষে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছিলেন, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে আমাদের দাবি যৌক্তিক ও ন্যায্য, এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও দেশের আপামর জনসাধারণের অভিপ্রায়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
অতএব, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং স্থায়িত্বশীল লক্ষ্যমাত্রার যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং স্বল্প জনসংখ্যার জাতিসত্ত্বাসমূহের কাংখিত আর্থসামাজিক উন্নতি সাধিত হয়েছে মর্মে যথাযথ সমীক্ষা-লব্ধ তথ্য, নির্দেশক ও সূচক প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িসহ দেশের স্বল্প সংখ্যার জাতিসত্ত্বার নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীসহ সকল সরকারী চাকরীর সংরক্ষিত আসন অব্যাহত রাখা ও পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিনীত আবেদন করছি।
Leave a Reply